প্রকাশিত: ২৪/০৬/২০১৮ ৬:৪৯ এএম , আপডেট: ১৭/০৮/২০১৮ ১:৩৫ এএম

অনেকের মনে শঙ্কা তৈরি হয়েছিল। গতবারের রানার্স-আপ আর্জেন্টিনার পথেই কি হাঁটছে চ্যাম্পিয়নরাও! মেক্সিকোর কাছে হেরে রাশিয়া বিশ্বকাপ শুরু হয় জার্মানির।

তাই সুইডেনের বিপক্ষে ম্যাচটি ছিল অনেকটা বাঁচা-মরার লড়াইয়ের মতোই। সেটি হারলে কিংবা ড্র হলেই তারা পৌঁছে যাবে খাদের কিনারে। সেই ভুল তারা করেনি। প্রথমে গোল খেয়েও বিপথগামী হয়নি। সেই ধাক্কা সামলে বরং এক ‘ক্লাসিক’ ম্যাচ উপহার দিয়েছে। শেষ মিনিটে ক্রোসের অসাধারণ শটে সুইডেনকে ২-১ গোলে হারিয়ে জার্মান ফুটবল রূপকথার এক নতুন অধ্যায়ের জন্ম দিয়েছে।
অন্যদিকে বেলজিয়ামকে এবার আর ‘ডার্ক হর্স’ বলা হচ্ছে না। কেভিন ডি ব্রুইন, এডেন হ্যাজার্ডদের সরাসরি ফেভারিটের তালিকায়ই রাখছে অনেকে। তাদের হতাশ হতে হচ্ছে না।

বেলজিয়াম কাল টানা দ্বিতীয় ম্যাচ জিতেছে বিশ্বকাপে নিজেদের অষ্টম গোল করে। পানামাকে হারিয়েছিল তারা ৩-০ গোলে। তুলনামূলক শক্তিশালী তিউনিসিয়া গতকাল পাত্তাই পায়নি রেড ডেভিলদের কাছে। রোমেলু লুকাকু ও এডেন হ্যাজার্ডের জোড়া গোলে ৫-২ ব্যবধানে ম্যাচ জিতে ‘জি’ গ্রুপ থেকে শেষ ষোলোয় যেমন এক পা দিয়ে ফেলেছে রবার্তো মার্তিনেসের দল, তেমনি দক্ষিণ কোরিয়াকে ২-১ গোলে হারিয়ে ‘এফ’ গ্রুপ থেকে মেক্সিকোও।
সোচিতে গতকাল ম্যাচ শুরুই হয় জার্মান যন্ত্রের দাপটে। তাতেই তছনছ হয়ে যেতে পারত সুইডেন। দু-দুবার দুর্দান্ত সুযোগ তৈরি করেও পারেনি বল জালে পৌঁছাতে। ৩ মিনিটে বক্সের ভেতর থেকে ড্র্যাক্সলারের শট ব্লক করেন গ্রাংকভিস্ট। তারপর এই জার্মান উইঙ্গার পোস্টের সামনে আরেকটি ক্রস ঠেলেন, এবার সতীর্থরা ব্যর্থ পা ছোঁয়াতে। শুরুর ঝড় সামলে সুইডেন ১২ মিনিটে জার্মান শিবিরে পাল্টা সতর্ক সংকেত পাঠায় কাউন্টার অ্যাটাকে। ক্রোসের পা থেকে বল কেড়ে নিয়ে মার্কাস বার্গ এক দৌড়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন বক্সে। পেছন থেকে দৌড়ে আসা বোয়াটেং আর আগুয়ান গোলরক্ষক নয়ারের ‘স্যান্ডউইচে’ সে যাত্রায় কোনো রকমে রক্ষা পায় জার্মানি। তবে ৩২ মিনিটে আর সুরক্ষিত থাকেনি চ্যাম্পিয়নদের গোলপোস্ট। ডানদিক থেকে ক্লায়েসন পোস্টের সামনে এত নিখুঁত বল তুলে দিয়েছেন, দুই ডিফেন্ডারের মাঝে থেকেও ওলা তোইভেননের কোনো সমস্যা হয়নি নয়ারকে ফাঁকি দিতে। সুইডেনের দুর্দান্ত এই গোলে খানিকটা হকচকিয়ে যায় জার্মানি, হয়তো বা দুঃস্বপ্ন হানা দিচ্ছিল।

তবে সেই শঙ্কায় একদম এলোমেলো হয়ে যায়নি। বরং বাকি সময় খেলে আরো গুছিয়ে। ফেরে শুরুর আধিপত্য এবং আক্রমণের ধার। তাতে ৩৯ মিনিটে ম্যাচে ফেরার প্রায় সব আয়োজন সেরে ফেলেছিল। কিন্তু অবিশ্বাস্য সেভ করে বসেন রবিন ওলসেন। প্রথমে গুন্ডোগানের শট, এরপর মুলারের ফিরতি শট ঠেকিয়ে এই সুইডিশ গোলরক্ষক হতাশায় ডুবিয়ে দেন জার্মানিকে। তার পরও এটা ন্যূনতম ব্যবধান, যেকোনো মুহূর্তেই ফেরা যায়। বিরতির আগে ওই বার্গের হেডে নয়ারের ডাইভিং সেভ না হলে তো ম্যাচটা আরো কঠিন হয়ে যায়।

সে হলেও যেন কোনো ক্ষতি বৃদ্ধি হতো না। কারণ বিরতির পর সে এক অন্য জার্মানি। একদম চ্যাম্পিয়নের বেশে তারা ফিরেছে মাঠে। তবে একটি পরিবর্তন, ড্র্যাক্সলারের জায়গায় আসেন মারিও গোমেজ। তাঁর একটু ছোঁয়াতেই ভাগ্য বদলে গেল জার্মানির। ওয়ার্নারের ক্রসে তিনি একটু পা ছুঁইয়ে দিয়েছিলেন আর সেটিই মার্কো রয়েস লক্ষ্যে পৌঁছে দিয়ে ম্যাচে ফেরান দলকে। ওলসেনের প্রতিরোধ শেষ হয়ে গেল ৫৪৮ মিনিটে। এরপর যেন এই গোলরক্ষকের ওপর ঝড় বইয়ে দিল জার্মানরা। ৭২ মিনিটে ওয়ার্নারের ক্রসে আত্মঘাতী গোল ঠেকিয়েছেন। ৮৭ মিনিটে ক্রোসের ক্রসে গোমেজের হেড তুলে দিয়েছেন ক্রসবারের ওপরে। এর মধ্যে বোয়াটেং দ্বিতীয় হলুদ কার্ড দেখে মাঠ ছাড়লে ১০ জনের দলে পরিণত হয় চ্যাম্পিয়নরা। কিন্তু খেলায় তাদের ১১ জনের তেজ। আর সেই দানবীয় শক্তি। যখন-তখন হয়ে যেতে পারে উইনিং গোল। ইনজুরি টাইমের শুরুর মিনিটেই ব্রান্ডের শট ফিরে আসে পোস্টে লেগে। কিন্তু শেষ মিনিটে আর কেউ বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। না পোস্ট, না ওলসেন। বাঁ-দিকে বক্সের একটু বাইরে থেকে নেওয়া টনি ক্রোসের দুর্দান্ত শটটি বাঁক খেয়ে দূরের পোস্টে চুমু খেলে এক রোমাঞ্চকর ম্যাচ জিতে চ্যাম্পিয়নদের ফেরা নিশ্চিত হয়। প্রথম ম্যাচে মেক্সিকোর কাছে হারা জার্মানি জয়ে ফেরে, দুই ম্যাচে ৩ পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপে এখন দ্বিতীয় স্থানে।

ওদিকে পানামার জালের দেখা পেতে প্রথম ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল হ্যাজার্ডদের। তবে কাল গোলমুখ খুলেছে মাত্র ৬ মিনিটে। দ্রিস মের্তেন্সের বাড়ানো বল ধরতে বক্সের ভেতর ছুটে যাওয়া হ্যাজার্ডকে ফাউল করে বসেন তিউনিসিয়ান ডিফেন্ডার। স্পটকিক থেকে হ্যাজার্ডই করেন প্রথম গোলটা। দ্বিতীয় গোল এর ১০ মিনিটের মধ্যে। আগের ম্যাচে জোড়া গোল করা রোমেলু লুকাকু এবার দৃশ্যপটে। সেই মের্তেন্সের কাছ থেকে বল পেয়ে সামনে এক ডিফেন্ডার রেখে অসাধারণ প্লেসিং শটে বল জালে পৌঁছে দিয়েছেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড স্ট্রাইকার। নাটকীয়তা এর মিনিট দুয়েক পরে। বক্সের বাইরে ফ্রি কিক পেয়ে তিউনিসিয়া এক গোল পরিশোধ করে ফেলে ডিলান ব্রনের হেডে। আফ্রিকান দলটির ম্যাচে ফেরার যে ইঙ্গিত ছিল তাতে তা মুছে যেতে অবশ্য সময় লাগেনি বিরতির আগেই লুকাকু ৩-১ করে ফেললে। থমাস মুনিয়েরের থ্রু বল পেয়ে তিউনিসিয়ান গোলরক্ষকের মাথার ওপর দিয়ে পাঠান তিনি দর্শনীয় চিপে। বিশ্বকাপে ক্রিস্তিয়ানো রোনালদোর সমান ৪ গোল এখন এই বেলজিয়ান স্ট্রাইকারের।

বিরতি থেকে ফিরে হ্যাজার্ড নিজের দ্বিতীয় গোল করেন। একটা লং বল বুক দিয়ে নামিয়ে তিউনিসিয়ান দুই সেন্টারব্যাকের মাঝখান দিয়ে বেরিয়ে যান, এরপর গোলরক্ষকও বাধা হতে পারেননি এই অ্যাটাকিং মিডফিল্ডারের। তিউনিসিয়ার দুর্ভাগ্য গোলদাতা ব্রন ম্যাচের ২৪ মিনিটেই চোট পেয়ে বেরিয়ে যান। ৪১ মিনিটে এই রাইটব্যাকের পথ ধরেন সেন্টারব্যাক বেন ইউসেফও। প্রতিপক্ষের নিয়মিত দুই ডিফেন্ডারের চোটের সুযোগটা নিয়েছে বেলজিয়াম ভালোভাবেই। দ্বিতীয়ার্ধে আরো শাণিত তাদের পারফরম্যান্স। হ্যাজার্ডের দ্বিতীয় গোলে ৪-১ হয়ে যাওয়ার পর মার্তিনেস বেঞ্চের খেলোয়াড়দেরও ম্যাচটাইম দেওয়ার সুযোগ পান। ৫৯ মিনিটে লুকাকু আর ৬১ মিনিটে হ্যাজার্ডকেও তুলে নেন তিনি। লুকাকুর জায়গায় নামা মিচি বাতসুয়াই এই ম্যাচে হ্যাটট্রিক পেতে পারতেন ওই আধঘণ্টাতেই। কিন্তু তিনবার সহজ সুযোগ নষ্ট করে চতুর্থবারে গোলের দেখা পেয়েছেন তিনি। প্রথমবার গোলরক্ষককে কাটিয়েও তাঁর শট জাল খুঁজে পায়নি, গোললাইন থেকে এক তিউনিসিয়ান ডিফেন্ডার বল ক্লিয়ার করে দিলে। পরেরবার পোস্টের একেবারে সামনে থেকে মেরেছেন উড়িয়ে। তৃতীয়বার ওই ছোট ডির সামনে থেকেই গোলরক্ষককে ফাঁকি দিতে পারেননি। অবশেষে সেই গোল ধরা দিয়েছে তাঁর কাছে ঠিক ৯০ মিনিটে। ইয়ানিক কারাসকোর ক্রসে চমৎকার ভলিতে বল জালে পাঠিয়েছেন গত মৌসুমেই চেলসি থেকে ধারে বরুশিয়া ডর্টমুন্ডে যাওয়া এই স্ট্রাইকার।

বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচেই ৫ গোল করা রাশিয়া দ্বিতীয় ম্যাচে করে আরো ৩ গোল। তাদের সমানই এখন ৮ গোল বেলজিয়ামের। আসরে এখনো পর্যন্ত যা সর্বোচ্চ। আর্জেন্টিনা, জার্মানি, স্পেন, ফ্রান্সের মতো দলগুলো যখন পোস্টের মুখে গিয়ে যুঝছে গোলের জন্য, সেখানে বেলজিয়ানদের এই গোলের ধারা যে তাদের সম্ভাবনাও বাড়াচ্ছে এই আসরে।

ফেভারিট বেলজিয়ামের মতো দৃপ্ত পদক্ষেপে এগোতে থাকা মেক্সিকো এবার বিশ্বকাপ অভিযানই শুরু করেছিল বর্তমান চ্যাম্পিয়ন জার্মানিকে ১-০ গোলে হারিয়ে। কাল রুস্তভ-অন-ডনে তাই দক্ষিণ কোরিয়াকে হারাতে তাদের তেমন বেগ পাওয়ার কথা ছিল না। ম্যাচের ২৬ মিনিটে বক্সের ভেতর কোরিয়ান খেলোয়াড়ের হ্যান্ডবলে পাওয়া পেনাল্টি থেকে গোল করে দলকে এগিয়ে নেন কার্লোস ভেলা। ২০১৪ বিশ্বকাপে পুরো আসরেই যেখানে হয়েছিল ১৩ পেনাল্টি, সেখানে এবার প্রথম রাউন্ড মাঝপথ পেরোতে না পেরোতেই হয়ে গেল ১৪ পেনাল্টি। ৬৬ মিনিটে ব্যবধান দ্বিগুণ করেন হ্যাভিয়ের হার্নান্দেজ। হার্ভিং লোজানোর বাড়ানো বল ধরে প্রথমে কাটান তাঁর সামনে থাকা ডিফেন্ডারকে। এরপর এগিয়ে আসা কোরিয়া গোলরক্ষকের পাশ দিয়ে বল জালে পাঠিয়ে করেন আন্তর্জাতিক ফুটবলে নিজের ৫০তম গোল। সনের দুর্দান্ত এক শটে গোল একটি ফিরিয়ে দিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া, তবে ততক্ষণে বড্ড দেরি হয়ে গেছে। গোলটি যে হয়েছে ম্যাচের ইনজুরি সময়ে। এই হারে কোরিয়ার বিদায় একরকম নিশ্চিত। যেমন একরকম নিশ্চিত টানা দ্বিতীয় জয়ে মেক্সিকোর দ্বিতীয় রাউন্ডে যাওয়াও।

পাঠকের মতামত